সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন

তালিকায় নেই শীর্ষরা

স্বদেশ ডেস্ক : জাতীয় সংসদে গতকাল শনিবার দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকা তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে দেখা গেছে, শীর্ষ ৩শ ঋণখেলাপির যে তালিকা রয়েছে তাতে বরাবরের মতোই এবারও আসেনি রাঘববোয়ালদের নাম। অর্থমন্ত্রীর তুলে ধরা তথ্যমতে, ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন ১৪ হাজার ৬১৭ জন। এসব ঋণগ্রহীতার অধিকাংশই ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন। সর্বসাকুল্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮৩ কোটি টাকা। এর আগে শীর্ষ ২০ ও ১০০ জন ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। দুজন সাংসদের প্রশ্নের উত্তরে এসব তথ্য প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী।

এ ছাড়া প্রকাশ করা হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের তালিকাও। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে বড় বড় গ্রুপের পক্ষে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব গ্রুপের একেকটিতে ৩০টা কোম্পানি পর্যন্ত রয়েছে। এসব কোম্পানির বিপরীতে ৩০ থেকে ৩৫টি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। অথচ অর্থমন্ত্রীর প্রকাশ করা তালিকায় এসব গ্রুপের নাম আসেনি; এসেছে তাদের দু-একটি কোম্পানির নাম। এ কারণে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছে পাওনার পরিমাণও বাস্তবের তুলনায় অনেক অনেক কম দৃশ্যমান হচ্ছে।

নিয়মানুযায়ী, এক ব্যক্তি বা গ্রুপের যে কোনো একটি কোম্পানি খেলাপি হলেই তিনি বা সেই গ্রুপ ঋণখেলাপি হিসেবে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) চিহ্নিত হবেন বা হবে। অর্থমন্ত্রীর তুলে ধরা ঋণখেলাপির তালিকায় একই ব্যক্তির বা গ্রুপের একাধিক কোম্পানির তথ্য দেওয়া হলেও ওই ব্যক্তি বা গ্রুপের সর্বমোট কী পরিমাণ ঋণখেলাপি হয়েছে, সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। অথচ বড় অংকের ঋণ নিয়ে সটকে পড়েছেন এসব ব্যক্তি ও তাদের গ্রুপ।

শীর্ষ ৩শ ঋণখেলাপির তালিকায় প্রথম নামটি চট্টগ্রামের সামানাজ সুপার অয়েলের। কোম্পানিটির নামে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। কার্যত এ কোম্পানিটির মূল হচ্ছে এসএ গ্রুপ। শাহাবুদ্দিন আলমের এ গ্রুপটি ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তিনি দীর্ঘদিন পরিচালক হিসেবে ছিলেন। তার কাছে ২৪টি ব্যাংকের পাওনা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তারই কোম্পানির একটি এসএ অয়েল রিফাইনারি। ৮ নম্বর তালিকায় থাকা এ কোম্পানির নামে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ৭০৭ কোটি টাকা। তারই আরেকটি কোম্পানি সামানাজ কনডেন্সড মিল্কের নামে খেলাপি রয়েছে ১২৭ কোটি টাকা, তালিকায় যেটি রয়েছে ১২৩ নম্বরে।

খেলাপির তালিকায় দ্বিতীয় নামটি গাজীপুরের গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা দেখানো হয়েছে ৯৮৪ কোটি টাকা। এ কোম্পানিটি কার্যত অ্যাননটেক্স গ্রুপের। এর কর্ণধার ইউনুস বাদলের ২২টি কোম্পানির বিপরীতে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ গ্রুপের ৬টি প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় এসেছে পৃথক পৃথকভাবে-সুপ্রভ কম্পোজিট ৬২০ কোটি, সুপ্রভ স্পিনিং ৬শ কোটি ও সিমরান ৫৮৯ কোটি, সুপ্রভ মোটর ৪৬ কোটি, সুপ্রভ মেলাঙ্গ স্পিনিং ১৬৭ কোটি, অ্যাননটেক্স নিট ২২৯ কোটি এবং জ্যাকার্ডের খেলাপি ৪৮৮ কোটি টাকা। অথচ গ্রুপটির মোট খেলাপি যোগ করা হলে খেলাপির অংকটা অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। তদুপরি এ গ্রুপেরই আরও কিছু কোম্পানির খেলাপি ঋণ তালিকায় তুলে ধরা হয়নি।

সম্প্রতি মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমান ঋণখেলাপের দায়ে আটক হয়েছেন। তার কাছে ৩১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অথচ তালিকায় মোস্তফা গ্রুপের একটিমাত্র কোম্পানি রয়েছে। ফলে তালিকায় তার কোম্পানির নাম এসেছে ২০৫ নম্বরে।

সাম্প্রতিককালে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের কছে জনতা ব্যাংকের পাওনা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অন্য কোম্পানির নামেও আরও ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি। শীর্ষ খেলাপির করা তালিকায় এ গ্রুপের মাত্র ৪টি কোম্পানির নাম রয়েছে-রিমেক্স ফুটওয়ার ৯৭৬ কোটি, রুপালি কম্পোজিট ৭৯৮ কোটি, ক্রিসেন্ট লেদার ৭৭৬ কোটি, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ ১৬৩ কোটি এবং লেক্সকোর খেলাপি ৪৩৯ কোটি টাকা। জাতীয় পার্টির নেতা মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের ক্রিস্টাল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ১২টি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।

তার সবগুলো প্রতিষ্ঠানের নাম আসেনি তালিকায়। এসেছে ইব্রাহিম কনসোর্টিয়াম ১৫০ কোটি, ইব্রাহিম টেক্সটাইল ৩৭৩ কোটি, ইব্রাহিম কম্পোজিট ৭৪ কোটি, ক্রিস্টাল স্টিল ১০৫ কোটি, ম্যাক ১১৩ কোটি, মা টেক্স ১১১ কোটি এবং ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ৩৭২ কোটি টাকা। গ্লোব গ্রুপের মাত্র তিনটি কোম্পানির বিপরীতে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে-গ্লোব মেটাল ১৫০ কোটি, গ্লোব এডিবল অয়েল ১৫০ কোটি এবং গ্লোব জনকণ্ঠ পরিবারের খেলাপি ৮০ কোটি টাকা।

শীর্ষ খেলাপির তালিকায় চারে আছে কোয়ান্টাম পাওয়ার (৮২৮ কোটি টাকা) এবং পাঁচ নম্বরে চট্টগ্রামের মাহিন এন্টারপ্রাইজ (৮২৫ কোটি)। শীর্ষের দশ নম্বরে থাকা গ্রামীণ শক্তির খেলাপি ঋণ ৬০১ কোটি টাকা।

তালিকায় হলমার্কের বিভিন্ন কোম্পানির নাম এসেছে পৃথকভাবে। এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ম্যাক্স স্পিনিংয়ের নামে ৫২৬ কোটি (১৪তম), আনোয়ার স্পিনিং ৪৭৫ কোটি (২০), হলমার্ক ফ্যাশনস ৩৪১ কোটি (৩১), টি অ্যান্ড ব্রাদার্স কম্পোজিট ১৯৭ কোটি (৫৫), ওয়ালমাট ফ্যাশন ১৭০ কোটি (৭৭) ও হলমার্ক স্পিনিং ৭২ কোটি (২৭৫তম) টাকা ঋণখেলাপি।

এ ছাড়া শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় রয়েছে গাজীপুরের সৌরভ স্পিনিংয়ের ৫৮২ কোটি (১১তম), কম্পিউটার সোর্স ৫৭৫ কোটি (১২), বেনেটেক্স ৫২৩ কোটি (১৫), আলফা কম্পোজিট ৫২৩ কোটি (১৬), সিদ্দিক ট্রেডার্স ৫১১ কোটি (১৭), রুবায়া ভেজিটেবল ৫০১ কোটি (১৮) এবং রাইজিং স্টিল ৪৯৪ কোটি টাকা (১৯তম)।

শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল ২৮৬ কোটি (৪১তম), কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ২০৪ কোটি (৫২) টাকা। তালিকায় আরও রয়েছে মন্নু ফেব্রিক্স (২৬৭ কোটি), আলোচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিসমিল্লাহ টাওয়েল (২৪৪ কোটি), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি (২০২ কোটি), ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (১৮০ কোটি), সিক্স সিজন ১৮৩ কোটি, বুলু ইন্টারন্যাশনাল ২১৪ কোটি, এপেক্স ১৩০ কোটি, কেয়া কসমেটিকস ৯৯ কোটি, অটবি ১১৮ কোটি, রূপায়ণ হাউজিং ২৮০ কোটি, অরনেট সার্ভিস ১৩৭ কোটি এবং দেশবন্ধু সুগার মিল ৮৪ কোটি টাকা।

আওয়ামী লীগের সাংসদ মো. ইসরাফিল আলমের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ তালিকা তুলে ধরেন। সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি বড় ব্যাংকের কাছ হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়েছে কয়েকটি গ্রুপ। এসব গ্রুপের নাম সর্বত্রই আলোচিত হলেও তালিকায় আসেনি। রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কারণে তারা ‘খেলাপি’ হয়েছেন, এমন অজুহাত দেখিয়ে বারবার তারা খেলাপির তালিকার বাইরে থেকে যাচ্ছেন এবং তাবৎ সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। আদালতের মাধ্যমে আদেশ নিয়ে খেলাপির তকমা কাটিয়ে তারা ভোগ করছেন সব সুযোগ-সুবিধা। সেসব ব্যক্তি ও গ্রুপের নাম তালিকায় স্থান পায়নি।

অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, শীর্ষ ৩শ ঋণখেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট পাওনা আছে ৭০ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা।

সংসদ সদস্য লুৎফুন নেসা খানের আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, গত ৩৯ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ২১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ সময়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন। ওই সংসদ সদস্য ২০০৯ সালে ঋণখেলাপি কত ছিল ও তাদের কাছে প্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ এবং ২০১৮ সালে ওই সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণও জানতে চেয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী এর জবাবে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি ডেটাবেইজে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের আগের কোনো তথ্য সংরক্ষিত নেই। তাই ২০০৯ সালের ঋণের তথ্য দেওয়া সম্ভব হয়নি।

অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯৫৪ জন; বর্তমানে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন। ২০১৫ সালে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ১০৫ কোটি টাকা; ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৩১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877